বাস্তু বিদ্যা হল এক গভীর জ্ঞান যার মাধ্যমে পাওয়া তথ্য ও উপায় গুলি ব্যবহার করে বানানো বা সাজানো যে কোন স্থাপনা এনে দিতে পারে সুস্বাস্থ্য ও অনেক শুভফল। বাস্তু শাস্ত্র হল এই ভারতবর্ষের এক সুপ্রাচীন স্থাপত্য বিষয়ক ফলিত ও কারিগরী বিদ্যা। এর ভিত্তি ছিল সুপ্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ভৌগোলিক অবস্থা ও জলবায়ু। সনাতন ধর্মের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদের অংশবিশেষ হল এই বাস্তু শাস্ত্র যা চার হতে পাঁচ হাজার বছর প্রাচীন। অথর্ব বেদের একটি অংশ হলো ‘স্থাপত্য বেদ’। এই স্থাপত্য বেদ হতেই বাস্তু বিদ্যা বা স্থাপত্য বিজ্ঞানের অবতারণা। মূলত হিন্দু মন্দির ও ধর্মীয় স্থাপত্যগুলো এই রীতিতে নির্মিত হলেও বিশাল প্রেক্ষাপটে তা বসবাসের গৃহ নির্মাণেও ব্যবহৃত হতো। এই শাস্ত্রটি মূলত স্থপতি ঋষিদের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল, আর তাদের শিষ্যদের তা অধ্যয়নের ও সংশোধনের অধিকার ছিল। প্রতিটি সংশোধনের জন্য যথার্থ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অত্যন্ত গভীর পর্যবেক্ষণ করে সর্বসম্মতভাবে সংশোধন করা হতো।
‘বাস্তু’ শব্দটি এসেছে ‘বস্তু’ থেকে- বস্তু মানে যেকোনো বস্তু; মূলত বাস্তু বলতে সব কিছুকেই বুঝায়- তা একটি স্থান হতে পারে- কিংবা একটা বাড়িও হতে পারে।
পৌরাণিক রূপক কাহিনী মতে একবার অসুর ও দেবতাদের যুদ্ধে দেবতারা অসুরদের সাথে পেরে উঠছিল না। তখন সবাই নিজ নিজ তেজ থেকে এক দেবতা সৃষ্টি করলেন, তার নাম হল বাস্তু দেব। ঊনি জন্ম নিয়ে দেবতাদের কল্যাণার্থে সকল অসুরদের বিনাশ করে তাদের খেয়ে ফেলতে থাকেন। কিন্তু তাঁর খিদে মেটেনা। শেষে ঊপায় না পেয়ে দেবতারা সেই বাস্তু দেবের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অবস্থান নেন এবং বাস্তু দেবের খিদে নিবৃত্ত হয়। তারপর তিনি এই পৃথিবীকে ধারণ করেন।
পঞ্চ মহাভূত:
এই পৃথিবী পঞ্চভূতাত্মক। এতে তত্ত্বের সমাবেশ ঘটেছে। এই পাঁচটি তত্ত্ব হল- ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ ও ব্যোম অর্থাৎ ভূমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশ। ঠিক একইভাবে মানুষের শরীরেও এই পাঁচটি তত্ত্বের মিশ্রণ ঘটেছে। অর্থাৎ এই পঞ্চভূতেই মানবদেহ সৃষ্ট। একইভাবে পৃথিবীর ওপর যে কোনও ধরণের নির্মাণ এই পাঁচটি তত্ত্বের ওপর গড়ে ওঠে। সুতরাং স্থূল ও সূক্ষ্ম উভয়ার্থেই এই তত্ত্ব কার্যকরী। মানুষ তার নিজের বুদ্ধিতেই এই তত্ত্বের রহস্য জেনেছে। কিন্তু এই পঞ্চভূতের সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য অন্তঃসম্বন্ধকে নিজের ইচ্ছানুসারে সামঞ্জস্য করার ক্ষমতা তার সাধ্যের বাইরে। সুতরাং প্রকৃতির পঞ্চভূতাত্মক ব্যবস্থাকে ব্যাহত না করে আমাদের চলতে হবে। যদি ওই ব্যবস্থায় কোনও রকমের নাক গলানো হয় তা হলে অনেক রকমের অঘটন বা বিপদ দেখা দিতে পারে। বাস্তুশাস্ত্রের নিয়মগুলি পড়লেই বোঝা যাবে, প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য করে আমরা যদি আমাদের বাসস্থান বা কর্মস্থলের নকশা তৈরী করি, তা হলে সেখানকার বাসিন্দা বা কর্র্মীদের মধ্যে পারস্পরিক মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠবে এবং জীবন কাটবে অপার সুখশান্তিতে।
বাস্তুর নিয়ম অথবা সিদ্ধান্ত গুলির পিছনে সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। শুধু তাই নয়, এর পিছনে রয়েছে গভীর বিজ্ঞানভিত্তি। পৃথিবীর ওপর সূর্যরশ্মির প্রভাব, পৃথিবীর চৌম্বকীয় ক্ষেত্র, বাতাসের গতি ও তার প্রভাব ইত্যাদি এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলির ওপর সম্পূর্ণভাবে নজর দেওয়া হয়েছে। আমরা জানি, ভোরের সূর্যরশ্মি মানুষের জীবনের পক্ষে অনেক উপকারী। কিন্তু সেই সূর্যের রশ্মিই মধ্যাহ্নের পরে অতটা উপকারী নয়, বরং ক্ষতিকারক।
আকাশ : অনন্ত বিশ্বব্রহ্মান্ডে রয়েছে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র। পৃথিবী তাদেরই মধ্যে একটি গ্রহ। বিশ্বব্রহ্মান্ডের অনন্ত মহাশূন্যেরই একটি স্থানে ঘূর্ণায়মান অবস্থায় বিরাজ করছে সে। আমাদের এই পৃথিবীর বাইরে মহাশূন্যে যে অসংখ্য গ্রহ-নক্ষত্র অবস্থান করছে সেই মহাশূন্যকেই আমরা বলি আকাশ বা স্পেস।
মহাশূন্যে প্রতিনিয়ত চলছে রহস্যলীলা। মহাশূন্যে নানা গ্রহ নক্ষত্রের প্রভাব পৃথিবীর বুকে প্রভাবিত হচ্ছে। পৃথিবীর প্রাণিজগতের ওপরও এর প্রভাব প্রতিফলিত হয় নিরন্তর। পৃথিবীর বুকে আসছে আলো, তাপ, চৌম্বক শক্তি এবং নানাবিধ শক্তি।
মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এ সবের জন্যেই পৃথিবীর বায়ুমন্ডল বা সমুদ্রে এবং নদীতে তৈরি হচ্ছে ঢেউ। প্রাণিজগতের ওপরও এই সমস্ত প্রভাব সদাসর্বদাই পড়ছে। জীবনের ওপর প্রভাব, বিশেষ করে মানবজীবনের ওপর প্রভাব নিয়েই জ্যোতিষশাস্ত্র বা জ্যোতির্বিজ্ঞান গড়ে উঠেছে। জ্যোতিষশাস্ত্র সূর্য, চন্দ্র, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শুক্র, শনি, রাহু, কেতু ইত্যাদি গ্রহের এবং রাশির সঙ্গে সম্পর্কিত। গ্রহনক্ষত্র এবং রাশিচক্র পৃথিবীর জীবনের ওপর প্রভাবিত। আকাশের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল শব্দ।
বায়ু : আমরা জানি বায়ু হল বিভিন্ন গ্যাসের সমন্বয়। পৃথিবীতে এই বাতাসে আছে অক্সিজেন – ২১ শতাংশ, নাইট্রোজেন – ৭৮ শতাংশ আর বাকি অংশে আছে অন্যান্য গ্যাস – হিলিয়াম, নিয়ন, আর্গন, কার্বন ডাইঅক্সাইড ইত্যাদি।
বায়ু প্রাণিজীবনের প্রধান প্রত্যক্ষ অবলম্বন। আর এই বায়ু আছে বলেই পৃথিবীর বুকে শব্দ সৃষ্টি হয়েছে। বায়ু শব্দকে বহন করে আর বায়ু থেকেই আসছে অনুভূতি বা স্পর্শ। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল স্পর্শ এবং শব্দ।
অগ্নি : ‘তেজ’ হল সমস্ত শক্তির উৎস। বৈদ্যুতিক শক্তি, তাপ শক্তি, আণবিক শক্তি এবং প্রাণিজ শক্তি – সব কিছুর মূলেই রয়েছে ‘তেজ’ অর্থাৎ সূর্য বা অগ্নি। আর এই অগ্নি থেকে সৃষ্টি তাপ আর আলোর। তাপ এবং আলোবিহীন জীবন আমরা ভাবতেই পারি না। সূর্য বা অগ্নি হল নেত্র, বায়ু হল প্রাণ, অন্তরিক্ষ হল আত্মা আর পৃথিবী হচ্ছে শরীর। সমস্ত জগতের আত্মাস্বরূপই হল সূর্য। সমস্ত প্রাণীর প্রাণশক্তির মূল কারণ হল সূর্যরশ্মি। সূর্য তার দিব্য এবং অমৃতরস দিয়ে সমস্ত প্রাণীর জীবন দান করে। এর বৈশিষ্ট্য হল শব্দ, স্পর্শ ও রূপ।
জল : প্রাণীজীবনে অন্যতম এবং মূল্যবান উপাদান হল জল। পৃথিবীর জল আছে বলেই প্রাণের এত পাচুর্য। প্রকৃতির বুকে এত সবুজের সমারোহ। গাছ-গাছালি, মানুষ, পাখি, জীবজন্তু প্রত্যেকেরই জল অত্যন্ত প্রয়োজন। এই পৃথিবীর তিন ভাগ জল আর এক ভাগ স্থল। আমাদের শরীরে যে রক্ত প্রবহমান, তার বেশিরভাগ অংশ জুড়ে আছে জল। মানবদেহের ৭০ শতাংশই হলো জল। আবার পৃথিবীর দিকে তাকালে দেখা যায় খাল, বিল, নদী, নালা, সমুদ্র, এমনকি আকাশের মেঘ, বৃষ্টি-সবার মাঝেই রয়েছে জল। আর এই জলের জন্যই পৃথিবীতে সৃষ্টি হয়েছে রসের। জলের বৈশিষ্ট্য হল শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রস।
পৃথিবী : ধরিত্রী বা পৃথিবী হল বৃহৎ একটি চুম্বক যার মধ্যে আছে উত্তর মেরু এবং দক্ষিণ মেরু। এর জন্যেই সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ আকর্ষণ। পৃথিবীর এই চৌম্বকক্ষেত্র জুড়ে রয়েছে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি। আর এর থেকেই পৃথিরীর সমস্ত বিষয়ে চেতন এবং অবচেতনের ফল লক্ষ্য করা যায়। অর্থাৎ জাগতিক এবং অজাগতিক শক্তি পরিলক্ষিত হয়।
ধরিত্রী বা পৃথিবীর দুই প্রান্ত সাড়ে তেইশ মধ্যাহ্নিক অবস্থায় আছে যার জন্য বছরের ছয় মাস উত্তরায়ণ এবং বাকি ছয় মাস দক্ষিণায়ন। পৃথিবী তার নিজের অক্ষে অর্থাৎ মেরু রেখার পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরছে। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে দিন এবং রাত্রির। আর পৃথিবী সূর্যকে কেন্দ্র করে তার কক্ষপথ ধরে সম্পূর্ণ পরিক্রমা করতে সময় নিচ্ছে প্রায় ৩৬৫ ১/৪ দিন অর্থাৎ এক বৎসর। আগেই বলা হয়েছে পৃথিবীর তিনভাগ জল আর একভাগ স্থল। ধরিত্রীতে এই পাঁচটি গুণই বর্তমান। যথা- শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ।
বাস্তু জ্ঞানের প্রায়োগিক দিক :
পৃথিবী প্রতিনিয়ত উত্তর-দক্ষিণ অক্ষে ঘুরছে। ঘূর্ণায়মান অবস্থায় উত্তর-পূর্ব দিকেই কাত হয়ে আছে। ভুমি, জল, অগ্নি, বায়ু ও আকাশের সঙ্গে রয়েছে মানুষের সম্বন্ধ। তাই আদিকাল থেকেই মানুষ বিচার-বিবেচনা করে ঠিক করেছিল যে, পুর্ব এবং উত্তর দিকে এরকম কোনও কিছু নির্মাণ বা বৃক্ষরোপণও অনুচিত যার ফলে সূর্যকিরণ বাধাপ্রাপ্ত হয়।
আপনাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে উত্তর দিকে ফাঁকা জায়গা রাখার অর্থ কী, কারণ সূর্যকিরণ তো পূর্ব দিক থেকে আসে।
আমরা সকলেই জানি, সূর্য সারা বছর একই পথে পূর্ব থেকে পশ্চিমে পরিক্রমণ করে না। একবার সে যায় উত্তরের পথে, আর একবার দক্ষিণপথে। প্রতি পথেই সে ছয়মাস ধরে নিয়মিত পরিক্রমণ করে। উত্তরের পথে পরিক্রমণ করে ২২শে ডিসেম্বর থেকে ২১শে জুন পর্যন্ত। এই সময়কে বলে সূর্যের উত্তরায়ণ। আবার দক্ষিণের পথে পরিক্রমণ কাল ২১শে জুন থেকে ২২শে ডিসেম্বর। এই সময়কে বলে সূর্যের দক্ষিণায়ন। কোন একটি স্থাপনায় সূর্য রশ্মির সারাটা দিন থেকে শুরু করে সারা বছরের প্রভাব গভীর পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে এই বাস্তু শাস্ত্রে। এমনকি মানুষের জীবনযাত্রায় সূর্যের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব থেকে অনেক সিদ্ধান্তই নেয়া হয়েছে সেখানে।
সূর্যরশ্মি বিভাজিত হয়েছে সাতটি রঙে। এর মধ্যে লাল উজানি রশ্মি হিতকর এবং অতিবেগুনি রশ্মি ক্ষতিকর। শাস্ত্রে দুপুরের আগের সূর্যরশ্মিকে শরীরের পক্ষে শুভকর বলা হয়েছে।
সূর্যরশ্মিতে এমন অনেক পদার্থ আছে যা মানুষ, জীবজন্তু ও গাছপালার বেঁচে থাকার পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই সৌরশক্তির জন্যই পানি বাষ্প হয়ে মেঘের সৃষ্টি হয় এবং বৃষ্টি হয়। এই রশ্মিই আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় ভিটামিন তৈরি করে। সৌররশ্মি এমন অনেক কীটপতঙ্গ ধ্বংস করে দেয় যা আমাদের শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর ও নানা রকম রোগ সৃষ্টিকারী।
প্রাকৃতিক চিকিৎসায় সূর্যরশ্মিতে নিহিত বিভিন্ন রং দিয়ে অনেক রকমের চিকিৎসাও হয়। আয়ুর্বেদ মতে মানুষের শরীরের পাঁচটি প্রধান ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে পঞ্চভূতের। এ তথ্য নতুন নয়। ভূমি, আকাশ, বায়ু, পানি, অগ্নি ও ধরিত্রীর সঙ্গে মানবের নিগূঢ় সম্পর্কের কথা পূর্বের পাতায় ছবি এবং নীচের দুটি তালিকার সাহায্যে ব্যাখ্যা করা হল।
উপরোক্ত তালিকা ও ছবি থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান, চক্রে নিহিত তথ্যাদি বুঝার জন্য সক্রিয় মনের প্রয়োজন।
বাস্তু শাস্ত্র ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি :
বাস্তুশাস্ত্র সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক এক ভাবনা, ‘দিক’ এবং ‘সৌরশক্তি’ ছাড়াও বাস্তুশাস্ত্র অনুযায়ী গৃহনির্মাণ মহাজাগতিক রশ্মির কম্পনের উপর নির্ভরশীল। আমাদের প্রাচীন মুনী ঋষিরা এই বাস্তুশাস্ত্রের জনক। তাঁদের অতীন্দ্রিয় কল্পনাশক্তি এবং অন্তর্দর্শনের ফসল হল বাস্তু। বলা বাহুল্য, মানবসমাজ এবং স্থাপত্যের ওপরে ব্রহ্মান্ডের মহাজাগতিক শক্তির সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রভাব প্রাচীন মুনী ঋষিদের অজানা ছিল না। স্বীয় সাধনার শক্তিতে নিখিল বিশ্বের ওই রহস্যময় শক্তিগুলির সম্যক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন তাঁরা।
পৃথিবীর বুকে মাধ্যাকর্ষণই একমাত্র শক্তি নয়। একাধিক চৌম্বকীয় এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তির সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁদের মতে, অগণিত ‘কম্পন’ পৃথিবীর বুকে ক্রিয়াশীল। সাম্প্রতিক পরীক্ষা থেকে দেখা গিয়াছে, এই মহাজাগতিক কম্পনগুলির উৎস এক ও অভিন্ন। এরই উৎস থেকে বিকীর্ণ হয়ে মহাজাগতিক শক্তি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডে ছড়িয়ে পড়ে। প্রাচীন মুনী ঋষি ভূপৃষ্ঠে এই মহাজাগতিক শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সচেতন হলেও, পশ্চিমি সমাজকে এ ব্যাপারে অবহিত করার কৃতিত্ব এক জার্মান বিজ্ঞানী ড. এর্মেজ হার্টম্যান-এর।
ড. হার্টম্যান ভূপৃষ্ঠের গায়ে তারের জালির মতো লেগে থাকা একগুচ্ছ রশ্মি আবিষ্কার করেন। ধণাত্মক এবং ঋণাত্বক আধারযুক্ত এই রশ্মিগুলি উল্লম্বভাবে ভূমি থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে – অনেকটা তেজস্ক্রিয় প্রাচীরের ধাঁচে। প্রতিটির ঘনত্ব ২১ সেন্টিমিটার। উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রতি ২ মিটার অন্তর এই ধরণের রশ্মি বিকিরণ হয়। মিশরে চিপোর পিরামিডের গাণিতিক বীজগুলির সঙ্গে এই মহাজাগতিক রশ্মিগুচ্ছের অত্যাশ্চর্য মিল রয়েছে। এর্মেজ হার্টম্যান এও আবিস্কার করেন যে ভূপৃষ্ঠ থেকে বিচ্ছুরিত রশ্মিগুলি পরস্পর ছেদ করে। এই ছেদবিন্দুগুলি মানবদেহের ওপর অত্যন্ত অশুভ প্রভাব ফেলতে পারে। কয়েকটি ক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে ‘হার্টম্যান নেটওয়ার্ক’-এর ছেদবিন্দু। অন্যান্য পারিপার্শ্বিক প্রভাব (শারীরিক, পরিবেশগত ইত্যাদি) ছাড়াও বাস্তুশাস্ত্রে ভূমি থেকে নির্গত হয়ে ভূমণ্ডল পরিবেষ্টনকারী এই শক্তির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে।
আমাদের জীবন নির্ভর করে প্রকৃতির পাঁচটি শক্তি- সূর্যের বিকিরণ, পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্র, মাধ্যাকর্ষণ, বাতাসের গতিবেগ এবং মহাজাগতিক শক্তি সমূহের উপর। সূর্যের রশ্মি হল তড়িৎ চুম্বকীয় বিকিরণ। এই বিকিরণের ব্যাপ্তি সুদূর বিস্তৃত ক্ষেত্রে, তা মহাজাগতিক রশ্মি থেকে বেতার তরঙ্গেও, সূর্যরশ্মির একটি সামান্য অংশ যা আমরা খালি চোখে দেখতে পাই এবং যা সাদা রঙের, পিছনে লুকিয়ে আছে রামধনুর সাত রং-বেনীআসহকলা (V I B G Y O R)। এই রংগুলি হল বেগুনি, নীল, আসমানি, সবুজ, হলুদ, কমলা ও লাল। আসলে রংগুলি রয়েছে বেগুনি থেকে লালের মধ্যেই। বেগুনি রঙের থেকে বেশি ক্ষমতার রশ্মিকে বলে অতিবেগুনি (Ultraviolet) রশ্মি। আর লাল রঙের থেকে বেশি ক্ষমতার রশ্মিকে বলে লাল উজানি (Infrared) রশ্মি। মানুষের জীবনে লাল উজানি রশ্মি অতি প্রয়োজনীয়। এই রশ্মির সাহায্যে প্যারালিসিস, পেশির বেদনা ও নানাবিধ রোগের উপশম সম্ভব। অথচ অতিবেগুনি রশ্মি মানুষের জীবনের পক্ষে ক্ষতিকর। এই অতিবেগুনি রশ্মির কারণে দেহে জিনঘটিত নানা রোগ সৃষ্টি তো হয়ই সেই সঙ্গে বিভিন্ন চর্মরোগ সৃষ্টি করে।
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে সূর্যরশ্মি বিজ্ঞান সম্পর্কে বিশদ আলোচনা আছে। বাস্তুশাস্ত্রের মূল কথাই হল, কেমন করে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির হাত থেকে মানবজীবনকে রক্ষা করে উপকারী লাল উজানি রশ্মির সুফল লাভ করা যায়। সেই কারণে বাড়িঘর এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে বাড়িতে অতিবেগুনি রশ্মি না ঢুকতে পারে। বরং লাল উজানি রশ্মির যাতায়াত অবাধ হয়। যেহেতু লাল উজানি রশ্মি আসে উত্তর-পূর্ব দিক থেকে সেই কারণে বাস্তুশাস্ত্রে বাড়ির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে বেশি খোলা রাখতে বলা হয়েছে। আবার অতিবেগুনি রশ্মি দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে বেশি পরিমাণে আসে বলে বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম দিকটি কম খোলা রাখার নির্দেশ দিয়েছে ব্স্তুশাস্ত্র।
বাস্তুশাস্ত্র মতে কিভাবে একটা বাড়িকে থাকার উপযোগী করে তোলা যায় :
প্রাচীন এই বাস্তুশাস্ত্রে ষোলটি কক্ষ ও মাঝখানে উঠোনযুক্ত বাড়িকে উত্তম মনে করা হয়েছে। পূর্বদিকে স্নানাগার ও জলাধার হবে। অগ্নিকোণে রান্নাঘর, বৈদ্যুতিক সাজসরঞ্জাম রাখার ঘর করতে হবে। উত্তরে দামি বা বহুমূল্য জিনিসপত্র রাখার ভাণ্ডার ও ধনসম্পদ রাখা যেতে পারে। অগ্নিকোণে (দক্ষিণ-পূর্ব) ও পূর্বদিকের মাঝখানে ঘি, তেল, দধিমন্হন ঘর হওয়া উচিত। এই ধরণের বাড়িকে উত্তম বলা হয়েছে।
পশ্চিম দিকে খাওয়ার ঘর হবে।পশ্চিম ও নৈর্ঋত (দক্ষিণ-পশ্চিম) দিকের মাঝখানে পড়ার ঘর অথবা অতিথি কক্ষ করা উচিত। বায়ু দিকে (উত্তর-পশ্চিম) দিকে পশুশালা, রথ বা বাহন রাখার জায়গা করতে হবে।পশ্চিম ও উত্তরের মধ্যে রোদনগৃহ বা শোককক্ষ তৈরি করা যেতে পারে। নৈর্ঋত দিকে পাদুকা রাখতে হবে। নৈর্ঋত ও পশ্চিম দিকের মাঝখানে শৌচাগার নির্মাণ করা যেতে পারে।পশ্চিম দিকে ছোট ছেলেমেয়েদের থাকার ঘর করা উচিত। বায়ু দিকে কুমারী মেয়েদের থাকার ব্যবস্থা থাকবে।কারণ এই রকম ঘরে কুমারী মেয়ে থাকলে তার বিবাহে বিলম্ব দোষ কেটে যাবে।
বাস্তু দিকদর্শন :
আধুনিক যুগে জমির অভাব, বড় বাড়ি তৈরি করাও প্রায় অসম্ভব। তবে ষোল ঘরের বাড়ি আজকের দিনে কল্পনা করাও বৃথা। ষোলকক্ষযুক্ত বাড়ি সম্ভব না হলে এগার কামরা, নয় কামরা, সাত কামরা, পাঁচ কামরাযুক্ত বাড়ি করা যেতে পারে।তাও যদি সম্ভব না হয়, তাহলে অন্ততপক্ষে তিন কামরার বাড়িও ভাল। এই প্রেক্ষিতে আধুনিক প্রয়োজনের কথা মনে রেখে আদর্শ বাড়ির জন্য বিভিন্ন অনুকূল দিক ও অন্যান্য পরামর্শের কথা বলা হয়েছে। পরিস্থিতি ও প্রয়োজন অনুসারে এই সব দিক ও পরামর্শ অনুসরণ করে অবশ্যই লাভবান হওয়া যায়।
বাড়ি তৈরি : জমির উত্তর-পূর্ব কোণে ভূমির দোষ উদ্ধার করা উচিত। শাস্ত্রমতে দোষ বা ত্রুটি সম্পন্ন করার পরই প্রথম খনন শুরু করা কর্তব্য। চারদিকের জমিকে প্রথমে সমান ভাবে চৌরস করে নিতে হবে। এরপর জমির ঢাল রাখতে হবে উত্তর-পূর্বে। ভিত্তিপ্রস্তর চান্দ্রমাস অনুসারে উপযুক্ত দিকে বিশেষ অনুষ্ঠান পূর্বক স্থাপন করতে হবে। নির্মাণ কাজ প্রথমে দক্ষিণ-পূর্ব দিক্ থেকে শুরু করতে হবে। পূর্ব এবং উত্তরে বেশি জায়গা ছাড় দিতে হবে। দক্ষিণ এবং পশ্চিম সীমানার পাঁচিল উত্তর ও পূর্ব দিকের চেয়ে উঁচু আর মোটা করতে হবে। মূল বাড়িটি রাস্তার তল থেকে কমপক্ষে দুই ফুট উঁচু করে করা উচিত।
মনে রাখা দরকার যে প্রথম খনন করার সময় শুভ মুহূর্ত অনুসরণ করা অবশ্য কর্তব্য। পর্যায়ক্রমে সর্বপ্রথম উত্তর-পূর্ব, তারপর উত্তর-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব এবং পরিশেষে দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ এইভাবে খনন করা উচিত।
ভিত্তিপ্রস্তর : বাস্তু বিশেষজ্ঞ ও জ্যোতিষীর পরামর্শ অনুযায়ী শুভ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা উচিত। প্রথম খননের ঠিক বিপরীত নিয়মে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে হবে। যথা: পর্যায়ক্রমে দক্ষিণ-পশ্চিম, দক্ষিণ-পূর্ব, উত্তর-পশ্চিম ও পরিশেষে উত্তর-পূর্ব।
সীমানা প্রাচীর : বাড়ির চারদিকে সীমানা প্রাচীর হওয়া বাঞ্ছনীয়। সীমানা প্রাচীর এবং মূখ্য বাড়ির মাঝখানে যেন ছাড় থাকে। সীমানা প্রাচীরের পশ্চিম দিকের দেওয়াল পূর্ব দিকের দেওয়ালের চেয়ে যেন বেশি উঁচু থাকে। যদি দক্ষিণ এবং পশ্চিমের দেওয়াল উঁচু করা সম্ভব না হয় তবে যেন দেওয়ালটিকে তুলনামূলকভাবে একটু মোটা করে তৈরি করা হয়।
সীমানা প্রাচীরের দ্বার : সীমানা প্রাচীরের দরজা নির্ভর করছে জমিটি কোন মূখী তার ওপরে। সীমানা প্রাচীরের দরজা কীভাবে তৈরি করতে হবে সে সম্বন্ধেও প্রামাণিক সূত্রগুলি প্রাচীন বাস্তুশাস্ত্রে বলা আছে। নীচে একটি তালিকার সাহায্যে এ বিষয়ে জানানো হল।
১। পূর্বমুখী জমি : উত্তর-পূর্বদিকের পূর্বে করতে হবে।
২। পশ্চিম মুখী জমি : উত্তর-পশ্চিমের পশ্চিম দিকে করতে হবে।
৩। উত্তরমূখী জমি : উত্তর-পূর্বের উত্তর দিকে।
৪। দক্ষিণমূখী জমি : দক্ষিণ-পূর্বের দক্ষিণ দিকে।
সীমানা প্রাচীরের দরজা যে দিকগুলিতে করা কোনও মতেই উচিত নয় তারও একটি তালিকা দেওয়া হল।
১। দক্ষিণ-পূর্ব দিকের পূর্ব দিকে।
২। দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের পশ্চিম দিকে।
৩। উত্তর-পশ্চিম দিকের উত্তর দিকে।
৪। দক্ষিণ দিকের মাঝখানে।
ব্রহ্মস্থান : জমির মাঝখানে অর্থাৎ একেবারে মধ্যস্থলে কোনও রকমের ভারী নির্মাণ কর্ম বাঞ্ছনীয় নয়। যেমন বিম কলাম, পিলার, দেওয়াল ইত্যাদি যেন জমির মাঝখানে না থাকে। একই রকমভাবে কোনও ঘরের মাঝখানে কোন রকমের ভারী কিছু বসানো বাঞ্ছনীয় নয়। কারণ মধ্যস্থলটি হল ব্রহ্মস্থান।
বারান্দা : উত্তর ও পূর্ব দিকে করতে হবে বারান্দা। বারান্দার ছাদের স্তর বাড়ির ছাদের স্তরের এক সমান যেন না হয়। বারান্দার উত্তর-পশ্চিম দিকে জুতো রাখবার জায়গা করা যেতে পারে।
নলকূপ ও সেপটিক ট্যাঙ্ক : নলকুপ, কুয়ো ইত্যাদি উত্তর-পূর্ব দিকে তৈরি করতে হবে। উত্তর-পূর্ব দিকের কোণসূত্রের উপর যেন নলকুপ বসানো না হয়। সেপটিক ট্যাঙ্ক দক্ষিণ-পূর্ব বা উত্তর-পশ্চিমে করা যেতে পারে। এটিও যেন কোণসূত্রের উপর না বসে।
ওভারহেড ট্যাঙ্ক : ওভারহেড ট্যাঙ্ক যেন দক্ষিণ-পশ্চিম দিকের পশ্চিমে হয়।
আউটহাউস : উত্তর বা পশ্চিম দিকে সীমানা প্রাচীরের দেওয়াল স্পর্শ না করে আউটহাউস তৈরি করতে হবে। আউটহাউসের উচ্চতা প্রধান দেওয়ালের উচ্চতার চেয়ে কম হওয়া বাঞ্ছনীয়।
গ্যারেজ : গ্যারেজ হওয়া উচিত দক্ষিণ-পূর্ব বা উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে।
বাইরে যাওয়ার দরজা : প্রধান দরজার চেয়ে ছোট আকারে অন্য দিকে যাওয়ার দরজা তৈরি করা উচিত। এই দরজার উচ্চতা প্রধান দরজার মতো রাখা যাবে, কিন্তু চওড়ায় দরজা যেন তুলনায় ছোট হয়।
খাওয়ার ঘর : খাওয়ার ঘরের অবস্থান নির্ভর করছে রান্নাঘরের অবস্থানের উপর। আদর্শ রান্নাঘর হিসাবে যদি দক্ষিণ-পূর্বে রান্নাঘরের অবস্থান হয়, তবে পূর্বদিকে খাওয়ার ঘর করা উচিত। এবং যদি উত্তর-পশ্চিমে রান্নাঘর হয় তবে পশ্চিম দিকে খাওয়ার ঘর করা উচিত। খাওয়ার টেবিল অবশ্যই আয়তাকার হওয়া উচিত। গোল বা ছয় কোণযুক্ত টেবিল না হওয়াই বাঞ্ছণীয়। খাওয়ার ঘরের দক্ষিণ-পূর্বে বা উত্তর-পশ্চিমে রেফ্রিজারেটর রাখা উচিত এবং উত্তর-পূর্বে খাওয়ার জল, জলের ফিল্টার ও বেসিন রাখতে হবে।
বসবার ঘর : বাড়ির এবং অতিথিদের বসবার ঘর হবে পূর্ব বা উত্তর-পশ্চিম দিকে। বাড়ির কর্তা পূর্ব বা উত্তর দিকে চেয়ে অতিথিকে আপ্যায়ন করবেন। বসবার জায়গাগুলি এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে অতিথি পশ্চিম বা দক্ষিণ দিকে তাকিয়ে কথা বলেন এবং বাড়ির কর্তা পশ্চিম বা দক্ষিণ দিকে থাকবেন। এতে বাড়ির কর্তা এবং অতিথি উভয়ের পক্ষে শুভ।
পড়ার ঘর : উত্তর বা পশ্চিম দিকের ঘরে পড়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কিন্তু পড়বার সময় অবশ্যই পূর্ব বা উত্তর দিকে তাকিয়ে পড়াশুনা করা উচিত। পড়বার টেবিলের ঢাকা বা টেবিল ক্লথ যদি হালকা সবুজ রঙের হয় তবে পড়াশুনায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করে। মনোবিজ্ঞানীদের তথ্য থেকেও এটা প্রমাণিত। পড়ার ঘরের দরজা উত্তর-পূর্ব দিকে হলে ভাল হয়।