ছায়াপথ মহাকর্ষীয় শক্তি দ্বারা আবদ্ধ একটি অতি বৃহৎ সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা যা তারা, আন্তঃনাক্ষত্রিক গ্যাস ও ধূলিকণা, প্লাজমা এবং প্রচুর পরিমাণে অদৃশ্য বস্তু দ্বারা গঠিত।
ছায়াপথকে হিন্দুশাস্ত্রে মন্দাকিনী, সরিৎগঙ্গা, আকাশগঙ্গা, অনন্তশায়ী নারায়ণ, বিরাটপুরুষ ইত্যাদি নামে অভিহিত করা হইয়াছে। এই ছায়াপথটি রাতের বেলা পরিষ্কার আকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে বিস্তৃত হালকা সাদা মেঘের মত দেখায়।
আমাদের এই সৌরজগত যে ছায়াপথে অবস্থিত তার গ্রিক নাম দেয়া হয়েছিল kyklos galaktikos বা “দুগ্ধশুভ্র বৃত্তপথ” (Milky way circle)। পরবর্তীকালে এই নামটিকেই ছায়াপথের সাধারণ নাম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
ঋষিগণের কল্পনায় আকাশপথে বালক ‘ধ্রুব’ – ভক্তিভরে যে স্থানে সপ্তর্ষি পরিবেষ্টিত হইয়া তপস্যায় মগ্ন ছিলেন, সেই উত্তরাকাশের ধ্রুবতারার ২৩.৫ – ২৫.৫ ডিগ্রী দূর দিয়া ঘুরিয়া দক্ষিনাকাশে অসীমে চলিয়া গিয়াছে এই দুগ্ধশুভ্র ছায়াপথ ।
ইংরেজি পোল স্টার (Pole star)। পৃথিবীর উত্তর মেরুর অক্ষ বরাবর দৃশ্যমান তারা ধ্রুবতারা নামে পরিচিত। এই তারাটি পৃথিবীর অক্ষের উপর ঘূর্ণনের সাথে প্রায় সামাঞ্জস্যপূর্ণভাবে আবর্তিত হয়। প্রাচীন কালে দিক নির্ণয় যন্ত্র আবিস্কারের পূর্বে সমূদ্রে জাহাজ চালাবার সময় নাবিকরা এই তারার অবস্থান দেখে দিক নির্ণয় করতো। সপ্তর্ষী মন্ডল এর প্রথম দুটি তারা, পুলহ এবং ক্রতু-কে সরলরেখায় বাড়ালে সেটি এ তারাটিকে নির্দেশ করে। এটি লঘু-সপ্তর্ষী মন্ডলে দেখা যায়।
রাত বাড়ার সাথে সাথে আকাশের দৃশ্যমান সকল তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে । শুধুমাত্র ধ্রুবতারাই মোটামুটি একই স্থানে অবস্থান (দৃশ্যত) থাকে। এটি আকাশের একমাত্র তারা, যেটিকে এ অঞ্চল হতে বছরের যে কোন সময়েই ঠিক এক জায়গায় দেখা যায়।
‘কালপুরুষ (Orion নীহারিকা)’ আকাশের সবচেয়ে পরিচিত তারামন্ডল হিসেবে গণ্য হতে পারে। এই মন্ডলটি খুব সহজেই চিহ্নিত করা যায়। শিকারী নামে সুপরিচিত এই মন্ডলের উল্লেখযোগ্য তারাগুলো মহাকাশের বিষুবীয় অঞ্চলে অবস্থান করায় পৃথিবীর সব অঞ্চল থেকে একে দেখা যায়। উত্তর গোলার্ধে শরতের শেষ সময় হতে বসন্তের প্রাথমিক সময় পর্যন্ত কালপুরুষ মন্ডলটি দেখা যায়।
কালপুরুষ মন্ডলে প্রচুর উজ্জ্বল তারা এবং গভীর আকাশের বস্তু রয়েছে। এখানে উল্লেখযোগ্য তারাসমূহের নাম উল্লেখিত হল:
• ল্যাম্বডা অরিয়নিস (Meissa) হল কালপুরুষের মাথা। অবশ্য আর্দ্রার উত্তরে বেশ কয়েকটি তারা দেখা যায় যার সবকটিই মাথা গঠন করে। বাংলায় এদের একত্রে মৃগশিরা বলা হয়।
• জেটা অরিয়নিস (Alnitak – ঊষা), এপসাইলন অরিয়নিস (Alnilam – অনিরুদ্ধ) এবং ডেল্টা অরিয়নিস (Mintaka – চিত্রলেখ) নামক তারা তিনটি পূর্ব আকাশে লুব্ধকের সামান্য উত্তর-পশ্চিমে থাকে এবং এই যুক্ততারাটি (Asterism) কালপুরুষের কোমরবন্ধ গঠন করে। এই তারাসমষ্টিটি এক সরলরেখায় উত্তর-পশ্চিম থেকে পূর্ব-দক্ষিণ দিকে মুখ করে অবস্থান করে। সর্ব উত্তরে চিত্রলেখ এবং সর্বদক্ষিণে ঊষা অবস্থান করে।
• আলফা অরিয়নিস বা “আর্দ্রা” তারাটি এর ডান কাঁধে অবস্থিত। এটি লাল বর্ণের তারা যার ব্যস শুক্র গ্রহের চেয়ে বেশি। কোমরবন্ধের তারাসমষ্টিটির উত্তরে দুইটি তারা আছে এবং এদুটির মধ্যে পূর্বদিকের তারাটিই হল “আর্দ্রা”। এটি কালপুরুষ মন্ডলের প্রথম তারা হলেও বাণরাজা (Rigel) অপেক্ষা মৃদু।
• গামা অরিয়নিস (Bellatrix – কার্তিকেয়) তারাটি এর বাম কাঁধে অবস্থিত। আর্দ্রার পশ্চিম দিকে তাকালে অতি সহজেই তারাটি চোখে পড়ে। এর অপর নাম হচ্ছে নারী যোদ্ধা বা Warrior woman।
• কার্তিকেয়’র পশ্চিমে ছোট ছোট কয়েকটি তারা ধনুকের আকৃতি ধারণ করে আছে দেখা যায়। এগুলো কালপুরুষের হাতের দন্ডের আকার দেয়।
• কাপ্পা অরিয়নিস (Saiph – কার্তবীর্য) ডান পায়ের হাটুর তারা। কোমরবন্ধের নিচে পূর্বদিকে এর অবস্থান।
• বিটা অরিয়নিস (Rigel – বাণরাজা) বাঁ পায়ের তারা যা কোমরবন্ধের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। এটি একটি অতিদানব নীলাভ-সাদা তারা। আকাশের উজ্জ্বলতম তারাগুলোর অন্যতম।
• আইওটা অরিয়নিস (Hatsya) তারাটি কালপুরুষের তরবারির ডগায় অবস্থিত।
• ইটা অরিয়নিস তারাটি ডেল্টা অরিয়নিস এবং বাণরাজা তারাদ্বয়ের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।
‘কালপুরুষ নীহারিকা’ (যা মিজার ৪২, এম ৪২ এবং এনজিসি ১৯৭৬ নামেও পরিচিত।) এটি একটি বিকীর্ণ নীহারিকা যা ছায়াপথের দক্ষিনে অবস্হিত এবং এটি একটি অন্যতম উজ্জ্বল নীহারিকা যা রাতের আকাশে খালি চোখে দেখা যায়। এম ৪২ এর অবস্হান ১,৩৪৪ ± ২০ আলোক বর্ষ এবং এটি পৃথবীর নিকটবর্তী বড় তারা গঠন অন্চলে অবস্হিত। কালপুরুষ নীহারিকাটি অনুমান করা হয় ২৪ আলোক বর্ষ জুড়ে। সূর্যের তুলনায় এটার ভর প্রায় ২০০০ বার। পুরাতন গ্রন্থে অনেক বার কালপুরুষ নীহারিকাকে ‘গ্রেট নীহারিকা’ বা’ ‘গ্রেট কালপুরুষ নীহারিকা’ বলা হয়েছে। কালপুরুষ নীহারিকাটি রাতের আকাশে সর্বোচ্চ যাচাইকৃত এবং ছবি ধারনকৃত এবং সর্বাধিক অধ্যায়িত ‘স্বর্গীয় বৈশিষ্ট্যময় নীহারিকা’।
কালপুরুষ নীহারিকা হল একটি নাক্ষত্রিক নার্সারি যেখানে নতুন তারার জন্ম হচ্ছে। কালপুরুষ নীহারিকা মধ্যে ‘Hubble Space Telescope’ – এর সাহায্যে 700 তারা ও সৌরজগৎ চারপাশে বিভিন্ন পর্যায়ে নির্মীয়মান রূপে অবলোকন করা গিয়েছে।