বজ্রযানেরই আরেক সাধনপন্থা হিসেবে তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের আর একটি শাখা গড়ে ওঠে যা কালচক্রযান নামে পরিচিত। এই সম্প্রদায়ের সর্বোশ্রেষ্ঠ দেবতা হলেন “শ্রীকালচক্র”। এখানে ‘কাল’ শব্দটির অর্থ ‘প্রজ্ঞা’ বা ‘শূন্য অস্তিত্ব’ এবং ‘চক্র’ অর্থ হলো ‘জাগতিক পদ্ধতি’ বা উপায়। অতএব, কালচক্র হলো “প্রজ্ঞা ও উপায়ের অদ্বয়াবস্থা” এবং সেই সঙ্গে বোধিচিত্ত এবং বজ্রসত্ত্ব তথা আদিবুদ্ধের সঙ্গে এক ও অভিন্ন।
‘কালচক্রযানে অনেক ভয়ঙ্কর ধরনের দেবদেবী বর্তমান যাঁদের মন্ত্র, মণ্ডল ও বলিদানের দ্বারা তৃপ্ত করতে হয়। প্রজ্ঞা ছাড়াও ‘কাল’ সময়ের দ্যোতক যার বিভাগ প্রাণবায়ুর দ্বারা সম্ভব হয় এবং যা স্নায়ুচক্রের মধ্যে বিস্তৃত থাকে। যোগাভ্যাসের দ্বারা এই প্রাণবায়ুকে সংযত করতে পারলে মানুষও সময়ের চক্রকে এড়াতে পারবে, ফলে তার সকল দুঃখের অবসান ঘটবে। কালচক্রযান বঙ্গদেশ, মগধ, কাশ্মীর ও নেপালে।’ ‘কালচক্রযানীদের মতে শূন্যতা ও কালচক্র এক এবং অভিন্ন। ভূত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ লইয়া অবিরাম প্রবহমান কালস্রোত চক্রাকারে ঘূর্ণ্যমান। এই কালচক্র সর্বদর্শী, সর্বজ্ঞ; এই কালচক্রই আদিবুদ্ধ ও সকল বুদ্ধের জন্মদাতা। কালচক্র প্রজ্ঞার সঙ্গে মিলিত হইয়া এই জন্মদান কার্যটি সম্পন্ন করেন। কালচক্রযানী-দের উদ্দেশ্যই হইতেছে কালচক্রের এই অবিরাম গতিকে নিরস্ত করা অর্থাৎ নিজেদের সেই কাল-প্রভাবের ঊর্ধ্বে উন্নীত করা। কিন্তু, কালকে নিরস্ত করা যায় কিরূপে? কালের গতির লক্ষণ হইতেছে একের পর এক কার্যের মালা; কার্যপরম্পরা অর্থাৎ গতির বিবর্তন দেখিয়াই আমরা কালের ধারণায় উপনীত হই। ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই কার্যপরম্পরা মূলত প্রাণক্রিয়ার পরম্পরা ছাড়া আর কিছুই নয়। কাজেই, প্রাণক্রিয়াকে নিরুদ্ধ করিতে পারিলেই কালকে নিরস্ত করা যায়। কালচক্রযানীরা বলেন, যোগসাধনার বলে দেহাভ্যন্তরস্থ নাড়ী ও নাড়ীকেন্দ্রগুলিকে আয়ত্ত করিতে পারিলেই পঞ্চবায়ুকে আয়ত্ত করিতে পারিলেই প্রাণক্রিয়া নিরুদ্ধ করা যায় এবং তাহাতেই কাল নিরস্ত হয়। ‘কাল’ নিরস্ত করাই যেখানে উদ্দেশ্য, সেখানে কালচক্রযানীদের সাধন-পদ্ধতিতে তিথি, বার, নক্ষত্র, রাশি, যোগ প্রভৃতি বা পঞ্চাঙ্গ একটা বড় স্থান অধিকার করিয়া থাকিবে ইহা কিছু বিচিত্র নয় ! এই জন্যই কালচক্রযানীদের মধ্যে গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যার প্রচলন ছিল খুব বেশি। তিব্বতী ঐতিহ্যানুসারে কালচক্রযানের উদ্ভব ভারতবর্ষের বাহিরে, ‘সাম্ভলা’ নামক কোনো স্থানে। পাল-পর্বের কোনও সময়ে তাহা বাঙ্গলাদেশে প্রবেশ লাভ করে।৷ — পুনঃ প্রচারে – তুর্যানন্দনাথ।