“তামগ্নিবর্ণাং তপসা জ্বলন্তীং বৈরোচনীং কর্মফলেষু জুষ্টাম্।
দুর্গাং দেবীং শরণমহং প্রপদ্যে সুতরসি তরসে নমঃ”।।
- আমি সেই বৈরোচিনী অর্থাৎ পরমাত্মা কর্ত্তৃক দৃষ্ট অগ্নিবর্ণা, স্বীয় তাপে শত্রুদহনকারিণী, কর্মফলদাত্রী দুর্গাদেবীর শরণাগত হই। হে সুতারিণি, হে সংসার-ত্রাণকারিণী দেবি, তোমাকে প্রণাম করি।
“নবযোন্যাত্মকমিদং চিদানন্দঘনং মহৎ ।
চক্রং নবাত্মকমিদং নবধাভিন্নমন্ত্রকম্ ।।” (যোগিনীহৃদয়ম্ ১/১৩)
— নবযোন্যাত্মক এই চক্র চিদানন্দঘন ও মহৎ। নবাত্মক এই চক্রের নবধা ভিন্ন মন্ত্র।
হে চিদানন্দস্বরূপিনী জননী, সচ্চিদানন্দ ব্রহ্মমোহিষী, চণ্ডী, ব্রহ্মবিদ্যা লাভার্থ আমরা তোমার ধ্যান করি । অজ্ঞান অন্ধকার নাশিনী, নিত্যমুক্তা পরাৎপরা জননী অখণ্ড-ব্রহ্ম বিদ্যা স্বরূপিনী, চিদানন্দ স্বরূপিনী জননী আমরা হৃৎপদ্মে তোমাকে সদা অনুধ্যান করি।
নবার্ণ-মন্ত্রঃ
ঋষ্যাদিন্যাসঃ – “ওঁ অস্য শ্রীসপ্তশতীস্তোত্রমন্ত্রস্য নারদঋষি-র্গায়ত্রীছন্দঃ শ্রীদক্ষিণামূর্তির্দেবতা হ্রীঁ বীজং স্বাহা শক্তির্মমেষ্ঠ-সিদ্ধার্থে বিনিয়োগঃ”।
মস্তকে – ওঁ নারদায় ঋষয়ে নমঃ।
মুখে – ওঁ গায়ত্রী ছন্দসে নমঃ।
হৃদয়ে – ওঁ শ্রীদক্ষিণামূর্তি দেবতায়ৈ নমঃ।
গুহ্যে – ওঁ হ্রীং বীজায় নমঃ।
পাদদ্বয়ে – ওঁ স্বাহা শক্তয়ে নমঃ।
সর্বাঙ্গে – ওঁ চণ্ডিকায়ৈ নমঃ।
এরপর করন্যাসঃ, অঙ্গন্যাসঃ করিয়া, দেবীর ধ্যানান্তে মানস পুজা করিতে হইবে।
পরে “ওঁ দেহীমহাত্মা-পুস্তকায় নমঃ” – এই মন্ত্রে পঞ্চোপচারে চণ্ডী পুস্তকের পুজা করিয়া “হ্রীং” এই শক্তি-বীজ-মন্ত্র ১০৮বার জপ পূর্বক নবার্ণ-মন্ত্র, উৎকীলন-মন্ত্র ও শাপোদ্ধার মন্ত্র জপ করিবে। অতঃপর, যথাক্রমে অর্গলাস্তোত্র, কীলকস্তব ও দেবীকবচ এবং রাত্রিসুক্তাদি পাঠ করিয়া চণ্ডীপাঠ আরম্ভ করিবে।
প্রত্যেক চরিত্র পাঠের পূর্বে সেই চরিত্রের ধ্যান-পাঠ ও সেই মূর্তির ধ্যান করিতে হয় । চণ্ডী পাঠান্তে দেবীসুক্ত ও চণ্ডীপাঠাপরাধ – ক্ষমাপন – স্তোত্রপাঠ ও দেবীর ধ্যান করিয়া এক গণ্ডুষ জল লইয়া –
“ওঁ গুহ্যাতিগুহ্য গোপ ত্রী ত্বং গৃহাণাস্মৎকৃতং জপং সিদ্ধির্ভবতু মে দেবী ত্বংপ্রসাদান্মহেশ্বরী” ।। এই মন্ত্রে দেবীর বাম হস্তের উদ্দেশ্যে জলগণ্ডুষ ত্যাগ করিয়া জপ সমর্পণ করিবে।
নবার্ণ-মন্ত্রঃ – “ওঁ ঐঁ হ্রীঁ ক্লীঁ হ্লীঁ হ্রীঁ ক্লীঁ নমঃ” ।।
শক্তি মন্ত্রের মধ্যে নবার্ণ মন্ত্র শ্রেষ্ঠ। নবার্ণ = নব + অর্ণ , অর্ণ অর্থে বর্ণ। স্বর্ণ শব্দেও অর্ণবাচক। নবার্ণ মন্ত্রে নয়টি বর্ণ রহিয়াছে বলিয়া উক্ত মন্ত্রের এই নাম হইয়াছে।
ঐঁ বীজ দ্বারা চিদ্রূপা মহাস্বরসতীকে সম্বোধন করা হইয়াছে ।
হ্রীঁ বীজ সদ্রূপাত্মিকা নিত্যা মহালক্ষ্মীকে সম্বোধন করা হইয়াছে ।
ক্লীঁ বীজ আনন্দরূপা মহাকালিকে সম্বোধনার্থে ব্যবহৃত হইয়াছে ।
হ্লীঁ বীজের দ্বারা হ্লাদিনী শক্তি ও স্থির মায়াবীজ (শত্রু স্তম্ভনের দেবী এবং স্তম্ভনবাণ-এর দেবী অষ্টম মহাবিদ্যা) কে সম্বোধন করা হইয়াছে ।
এক কথায় নবার্ণ-মন্ত্রের অর্থ,- “হে সচ্চিদানন্দরূপিনী ব্রহ্মমহিষী, চণ্ডী, ব্রহ্মবিদ্যা লাভার্থ আমরা তোমার ধ্যান করি।
নবার্ণ মন্ত্রের ঋষি হইলেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর-শিব, এই মন্ত্রের ছন্দ হইল গায়ত্রীছন্দ, উষ্ণিকছন্দ ও অনুষ্টুপছন্দ। দেবী হইলেন কালী, লক্ষ্মী ও সরস্বতী। এই মন্ত্রের শক্তি – নন্দা, শাকম্ভরী ও ভীমা। এই মন্ত্রের বীজ হইল – রক্তদন্তিকা , দুর্গা ও ভ্রামরী এবং তত্ত্ব হইল অগ্নিতত্ত্ব, বায়ুতত্ত্ব ও সূর্য।
শ্রী শ্রী চণ্ডী হইল মাতৃমিলনের তিনটি তরঙ্গ। সচ্চিদানন্দ সমুদ্রে অবগাহন করিবার পর যে তিনটি তরঙ্গ আসিয়া জীবত্ত্বের অচ্ছেদ্য গ্রন্থি সম্যক উচ্ছেদ করিয়া দিয়া থাকে, তাহাই চণ্ডীর তিনটি রহস্য। এক-একটি গ্রন্থি ভেদ করিবার সময় সাধকের হৃদয়ে বিশ্ব প্রকৃতি “মা” যেরূপ ভাবে আত্ম প্রকাশ করেন, তাহাই হইল চণ্ডীর এক-একটি রহস্য।
প্রথমতঃ মধুকৈটভ বধ বা ব্রহ্মগ্রন্থি ভেদ, দ্বিতীয়তঃ মহিষাসুর বধ বা বিষ্ণুগ্রন্থি ভেদ, তৃতীয়তঃ শুম্ভবধ বা রুদ্রগ্রন্থি ভেদ।
শাস্ত্রের অন্তর্নিহিত অর্থ প্রকাশের জন্য প্রয়োজন সাধনা, – সাধনার ফল ‘অনুভূতি’।
শ্রী শ্রী চণ্ডী মূল গ্রন্থ নহে । ইহা মার্কণ্ডেয় পুরাণের অংশ। অষ্টাদশ পুরাণের অন্তর্গত মার্কণ্ডেয় পুরাণের ৮১তম অধ্যায় হইতে ৯৩তম অধ্যায় লহিয়াই এই শ্রীশ্রীচণ্ডী। দেবী মাহাত্ম্য এবং দুর্গা সপ্তশতী নামে ইহা আখ্যাত হইয়া থাকে। কারণ, – ইহার ১৩টি অধ্যায়ে ৫৭৮টি শ্লোক এবং ৭০০ মন্ত্র রহিয়াছে। বক্তাদিগের ৬টি পরম্পরা
অনুসারে জগতে দেবীমাহাত্ম্য বা চণ্ডীর প্রবর্ত্তন হয় এইভাবে, —
ব্যাসদেবশিষ্য জৈমিনি মহাভারত পাঠ শেষ করিয়া কয়েকটি বিষয়ে স্পষ্ট রূপে বুঝিতে পারিতেছিলেন না। নিজের অবসর না থাকায় ব্যাসদেব জৈমিনিকে বিন্ধ্যপর্বতে পক্ষীরূপধারী চারিজন মুনিপুত্রের নিকট পাঠাইলেন। পিতার অভিশাপে তাঁহারা পিঙ্গাখ্য, বিরাধ, সুপুত্র ও সুমুখ নামে চারিটি পক্ষীতে পরিনত হইলেও তপস্যার প্রভাবে তাঁহাদের স্মৃতিতে সবকিছু রহিয়াছিল এবং মনুষ্যের ন্যায় তাঁহারা কথাও বলিতে পারিতেন। তাঁহারা জৈমিনির নিকট সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় ইত্যাদি বিষয়ে বহু কথা বলিবার পর “দেবী মাহাত্ম্য” কীর্ত্তন করেন। সর্বপ্রথম এই দেবী মাহাত্ম্য (১) মেধাঃ নামক ঋষি (২) রাজা সুরথ ও বৈশ্য সমাধির নিকট বর্নণা করেন। সেই কাহিনী পরে (৩) মার্কণ্ডেয় মুণি শিষ্য (৪) ভাণ্ডারীর নিকট বলেন। ভাণ্ডারীর দ্বারা কথিত সেই বিবরণ পরে দ্রোণমুণির-পক্ষীরূপ (৫) চারিপুত্র (৬) জৈমিনিকে বলেন। এই রূপে দেবী মাহাত্ম্য ও চণ্ডীর প্রবর্ত্তন হয় এবং এই ছয়টি পরম্পরা হইতে ইহাকে ষট্-সংবাদ-কথা বলা হইয়া থাকে।
চণ্ডীতে রহিয়াছে , – সকল দেবতা আপন আপন শক্তি দিয়া দেবীকে “সম্বিল্লিত শক্তি” রূপে উৎপন্ন করাইলেন, এবং নিজ নিজ শক্তি রূপ নানা সজ্জায় সাজাইয়া তাঁহার দ্বারা অসুরগণকে (রিপুগণকে) পরাজিত করাইলেন। শেষে সেই মহাশক্তি পুণরায় সেই দেবতা গণের শরীরে প্রবেশ করিলেন।
যোগীর অন্তরস্থ যোগশক্তি সকল সম্বিল্লিত হইলে যে “চৈতন্যময়ী মহাশক্তি”-র আবির্ভাব হয়, তাহাই “কালী” – তিনিই কামক্রোধাদি অসুর বিনাশ করিয়া থাকেন।
মেধস ঋষি রাজা সুরথ ও সমাধি নামক বৈশ্যকে মহাশক্তির আবির্ভাব এবং অসুর নিধনান্তে দেব-দেহতেই তিরোভাবের বিষয় বুঝাইয়া দিলেন। এই যুদ্ধই হইল “মহাসাধন”।
চণ্ডীগ্রন্থে যোগ-সাধনের পথ ইঙ্গিত করা হইয়াছে মাত্র, ইহাতে অনিষ্টের কিছুই নাই। এই চণ্ডীপাঠ সকলেই করিতে পারেন, তবে বিশেষ সংকল্প করিতে হইলে দ্বিজ-ব্রাহ্মন দ্বারাই করাইতে হইবে।
দ্বিতীয় মনু স্বরোচিষ যখন সারা পৃথিবীর অধিশ্বর ছিলেন, তখন তাঁহার জ্যেষ্ঠপুত্র চৈত্রের বংশে ‘সুরথ’ নামক এক রাজা ছিলেন। এই সুরথ রাজাই মনের দুঃখে গভীর অরণ্যে গিয়াছিলেন, – মেধস ঋষির আশ্রমে। এই সুরথ রাজার সহিত ঐ অরণ্যে সাক্ষাৎ হইয়াছিল ‘সমাধি’ নামক এক ধনী বৈশ্যের। এই ‘সমাধি’-ও অরণ্যে আসিয়াছিলেন মনের দুঃখে, মেধস ঋষির আশ্রমে। মেধস ঋষি রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্যকে দেবী মাহাত্ম্য বা চণ্ডী বর্ণনা করিয়াছিলেন। এই চণ্ডীগ্রন্থে আমরা পাইয়া থাকি যুদ্ধের বিবরণ, – দেবতা ও অসুরের মধ্যে যুদ্ধের বর্ণনা, – দেবী কর্ত্তৃক অসুরগণের নিধন কাহিনী। মূল চরিত্রের মধ্যে রহিয়াছে ভগবান্ বিষ্ণু, ব্রহ্মা, মহাকালী, মহালক্ষ্মী, মহাসরস্বতী , মধু-কৈটভ, মহিষাসুর, শুম্ভাদি অসুরগণ।
চণ্ডীর প্রথম অধ্যায়ে রহিয়াছে –
“স্বরোচিষেহন্তরে পূর্ব্বং চৈত্রবংশ-সম্ভুদ্ভবঃ।
সুরথো নাম রাজাভূৎ সমস্তে ক্ষিতি মণ্ডলে”।।
স্বর্ = স্বর্গ, রোচিস্ = দীপ্তি, জ্যোতি। অর্থাৎ, স্বরোচিষ শব্দের অর্থ ‘স্বর্গীয় জ্যোতি’। অন্তর্জগত দিব্য জ্যোতি দ্বারা উদ্ভাসিত হইলেই জীব সুরথ হইতে পারে। যাঁহার গুরুপদিষ্ট উপায়ে বোধ-যোগের সাহায্যে সর্ব্বত্র মাতৃ-দর্শনে অভ্যস্থ হয়েন, অচিরে তাঁহার অন্তর স্বরোচিষ হইয়া থাকে। অন্তরবাহ্যভেদী দিগন্তব্যাপী জ্যোতির্মণ্ডলে অবস্থান করিয়া জীব আপনাকে পরম আনন্দময় পুরুষ বলিয়া উপলব্ধি করিয়া থাকে।
যোগ শাস্ত্রে ইহাকে বলা হইয়াছে সুষুম্না নাড়ী ভেদ, তন্ত্র শাস্ত্রে কুণ্ডলিনী জাগরণ, পাতঞ্জল যোগশাস্ত্রে ইহাকে বিশোকা বা জ্যোতিষ্মতী বৃত্তি বলা হইয়াছে, বেদান্তে বলা হইয়াছে ‘চিদাভাস’।
“চৈত্রবংশসমুদ্ভবঃ” – (চিত্র + ষ্ণ = চৈত্র ) বিচিত্র নানা যোনি ভ্রমন করিয়া জড়পরমানু হইতে ক্রমে গুল্ম, লতা, বৃক্ষ, কীট-পতঙ্গ, পক্ষী, পশু, বন্য অসভ্য, অর্ধসভ্য প্রভৃতি অসংখ্য যোনি, অসংখ্যবংশ ভ্রমন করিয়া ‘জীব’ সুরথ হইয়া থাকে অর্থাৎ প্রকৃত মানুষ হইয়া থাকে। জীব যতদিন ভগবৎসত্তায় বিশ্বাসবান হইতে না পারে, যতদিন জগন্মূর্ত্তিকে মহামায়া রূপে বুঝিতে না পারেন, ততদিন তাঁহার দেহ রথমাত্র রহিয়া থাকে। সুরথ হয় না।
যখন আধ্যাত্মিকাদি দুঃখ-ত্রয়ের একান্ত নিবৃত্তি এবং অত্যন্ত নিবৃত্তির উপায়-বিষয়ক যথার্থ জিজ্ঞাসু হইয়া থাকে তখনই জীব সুরথ হইয়া থাকে।
জীব সুরথ হইলে তখনই তাঁহার ক্ষিতি মণ্ডলের আধিপত্য লাভ হইয়া থাকে। আর, তখনই ঈশ্বরে বিশ্বাস দৃঢ় হয়। হৃত-রাজ্য ভূপতি রাজা সুরথ মৃগয়ার ছলে একাকী অশ্বারোহন পূর্বক গহন অরণ্যে গমন করিয়া ছিলেন । ‘মৃগয়া’ শব্দের অর্থ, – অন্বেষন, অর্থাৎ আত্মানুসন্ধান । ‘হয়’ – শব্দের অর্থ অশ্ব, এইস্থলে ‘হয়’ অর্থে ইন্দ্রিয় রূপ অশ্ব বুঝিতে হইবে । ‘গহন বন’ শব্দের অর্থ বিষয়ারণ্য । ‘হৃতসাম্য’, – অর্থ হৃত রাজ্য । মানুষ তখনই নিজেকে হৃতসাম্য বোধ করিয়া থাকেন যখন তিনি ভাব-সমরে পরাজিত, – সংস্কার শ্রেনী তাঁহার প্রতিকূল। সংস্কার গুলি হইল তাঁহার প্রধান শত্রু, নিত্যশুদ্ধবুদ্ধাত্বাদিরূপ বল অপহৃত হইয়াছে, দেহরাজ্যে ও মনোরাজ্যে এমনকি জ্ঞানময় ক্ষেত্রে, মনের আনন্দ কেন্দ্রের সর্বত্র প্রভূত্ব করিবার সামর্থ্য লোপ পাইয়াছে। এইরূপ অবস্থায় জীবের বিষম বিষাদ উপস্থিত হইয়া থাকে, এরূপ বিষাদ অবশ্য বাহিরে প্রকাশ করিবার নহে।
সুরথের বিষাদ প্রকাশ পাইয়াছিল সূক্ষ্ম এবং কারণ দেহে। মনুষ্য প্রথমতঃ আত্মজ্ঞান লাভের জন্য উদ্যত হইয়া চিত্তবৃত্তি গুলি নিরোদ করিতে যত্নবান হন, নানাবিধ যোগ কৌশলাদি উপায়ের দ্বারা বাহ্য বিষয় হইতে নিজ চিত্তকে প্রত্যাহৃত করিতে সচেষ্ট হন, কিন্তু, যথার্থ অমরত্বের সন্ধান তাহাতে পাওয়া যায় না, যথার্থ শান্তির ও আনন্দের কেন্দ্র তিনি খুঁজিয়া পান না। কারণ, এতদিন তাহার লক্ষ্য ছিল, – সংযম, যোগ ধ্যান-শক্তি, সিদ্ধি ইত্যাদির প্রতি। এতদিন তিনি মা-কে চাহেন নাই। কিন্তু, এক্ষণে তাহার ভ্রম কাটিয়া গিয়াছে, ঋষিগণ-সেবিত অতি সরল পন্থাটির দিকে তাঁহার দৃষ্টি পড়িয়াছে। এখন তাঁহার যথার্থ মাতৃ অন্বেষনে প্রাণ ছুটিয়াছে । তাই এখন তিনি ইন্দ্রিয়রূপ অশ্বে আরোহন করিয়া বিষয়ারণ্যে গমন করিয়াছেন এবং মায়ের সন্ধান আরম্ভ করিয়াছেন। ইহাই হইল চণ্ডীর বুদ্ধিযোগ। এই বুদ্ধি যোগ-ই চিত্ত চাঞ্চল্য দূরীভূত করিবার অব্যর্থ অস্ত্র স্বরূপ।
অরণ্য মধ্যে সুরথ দ্বিজ-বর মেধসের আশ্রম দেখিতে পাইলেন। ঐ আশ্রমটি প্রশান্ত শ্বাপদ সমূহের দ্বারা আকীর্ণ এবং মুণি-শিষ্যগণ কর্তৃক উপশোভিত। ‘মেধস’ শব্দের অর্থ মেধা বা স্মৃতিশক্তি । যাহাতে আত্মস্মৃতি উদ্বুদ্ধ করে, তাহাই মেধস পদবাচ্য। ‘দ্বিজবর্য্য’, – শব্দের অর্থ ব্রাহ্মণশ্রেষ্ঠ। এক্ষেত্রে ‘ধী’ বা বুদ্ধি তত্ত্বই ব্রাহ্মণ । ধী এবং মেধা প্রায় অভিন্ন। এই ‘ধী’ যখন প্রথম উন্মেষিত হইতে থাকে, তখন উহা স্মৃতির আকারেই প্রকাশ পায়। সেকারণে এই স্থলে বুদ্ধি বা ‘ধী’ না বলিয়া মেধস বলা হইয়াছে। মেধার স্থান বা বুদ্ধিময় ক্ষেত্রকেই মেধস ঋষির আশ্রম বুঝিতে হইবে। এই স্থানই ব্রহ্ম জ্ঞানের উন্মুক্ত দ্বার, সাধকের সুষুম্না প্রবাহ উন্মেষিত হইলেই তখন তিনি এই ক্ষেত্রে উপস্থিত হইতে পারেন।